ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা অযৌক্তিক ?


ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা অযৌক্তিক ?
আহমদ আল হুসাইন
‘’ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার ভিত্তিতে ছাত্র ভর্তি করাকে অযৌক্তিক বলে উল্লেখ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি বলেছেন, ভর্তি পরীক্ষার সাথে কোচিং বাণিজ্য একসূত্রে গাঁথা থাকায় যে সব পিতা-মাতা বেশি টাকা খরচ করতে পারেন কেবল তাদের ছেলেমেয়রাই বেশি সুযোগ পায় ’’ শিক্ষা মন্ত্রীর এই ধারনাই সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং একেবারেই শিশুতোষ । ভার্সিটির ভর্তি পরিক্ষা সম্পর্কে যে তিনি একেবারেই অবলা তা সুস্পষ্ট । মুখস্ত বিদ্যার উটে ভর করে যারা এসএসসি এবং এইচএসসি র পথ পাড়ি দেয় তারাই ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষার ছাকনীতে আটকা পড়ে যায় । মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত আর মুখস্ত বিদ্যার দৌড় ওই এইচএসসি পর্যন্তই । এমন অনেক ছাত্র আছে যারা স্কুল , কলেজে পড়ার সময় পাঁচ ছয় টা স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ে কারণ তাদের বাবার টাকা আছেকিন্তু একজন গরিবের ছেলের জন্য স্কুল , কলেজের ক্লাসই যথেষ্ট । প্রাইভেট পড়া তার জন্য আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছুই না । ধনীদের ছেলে মেয়েরাই নামি দামি স্কুল কলেজেই পড়ে । আর নামি দামি স্কুল কলেজের ফলাফল বরাবরই ভালো । একজন মফস্বলের স্টুডেন্ট যে কিনা মেধাবী , কিন্তু ভালো শিক্ষকের অভাবে , লেখাপড়ার ভালো পরিবেশের অভাবে সে তার মেধার বিকাশ ঘটাতে পারে না । মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও সে এসএসসি , এইচএসসি পরিক্ষায় ভালো ফলাফল করতে পারে না। অপেক্ষাকৃত ভাবে ধনীদের ছেলে মেয়েরাই ভালো রেজাল্ট করে । আর ভার্সিটিতে যদি এই ভালো রেজাল্ট করার ভিত্তিতে ভর্তি নেওয়া হয় তাহলে এটা মেধার অবমূল্যায়ন ছাড়া আর কিছুই নয় ।

মন্ত্রি সাহেব বলেছেন , “মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকে যে শিক্ষার্থীরা ৮৩ ঘণ্টা পরীক্ষা দিয়ে পাস করে আসে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির নামে তাদের এক ঘণ্টা পরীক্ষা নেয়া হয়, এটা অযৌক্তিক।কিন্তু কিভাবে ? তার মানে কি তিনি এটাই বুঝাতে চাচ্ছেন যে শিক্ষার্থীরা ৮৩ ঘণ্টা পরীক্ষা দিয়ে পাস করে এসেছে । এখন ভার্সিটির ভর্তি পরিক্ষা হবে ২০ ঘণ্টা কিংবা ৩০ ঘণ্টা । সমতা বলতে তো একটা কথা আছে !! ইস্তিমার ময়দানের মত শিক্ষার্থীরা বালিশ কাথা নিয়ে ভার্সিটিতে ভর্তি পরিক্ষা দিতে আসবে । ২০ ঘণ্টা কিংবা ৩০ ঘণ্টার পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করবে । এতে করে তাদের মেধা যাচাই হবে । যারা ভালো করবে , তারাই ভার্সিটিতে পড়ার যোগ্যতা রাখবে । মন্ত্রি সাহেবের ৮৩ ঘণ্টার উদ্ভট যুক্তি অনেকটা পাগলের প্রলাপই
আস্থার কথা বলতে গিয়ে তিনি অনাস্থার বাইস্কপ দেখিয়েছেন মাত্র । শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, “এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ওপর আপনাদের আস্থা নেই বলে আপনারা ভর্তি পরীক্ষা নেন। প্রশ্ন হলো, যারা এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষা দিলো, তারা তো আপনাদেরই ছাত্র। আপনাদের ছাত্র-ছাত্রীদের উপরেই আপনাদের যদি আস্থা না থাকে, তাহলে আপনাদের ওপর মানুষ আস্থা রাখবে কিভাবে?” বেশ ভালো প্রশ্ন রেখেছেন তিনি । আমার ভাবনার আকাশেও এমন আস্থার পায়রা উড়াউড়ি করছে । ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পাওয়া একজন স্টুডেন্ট এর উপরে আমার আস্থার শেষ নেই । অনেক আস্থা । ভরি ভরি আস্থা । পাহাড়সম আস্থা আছে আমার । আমি তাকে ক্লাস সিক্সে ভর্তি করালাম । বছর শেষে ক্লাস সিক্সের ফাইনাল পরিক্ষা নেওয়ার কোন দরকার নেই । কারণ ক্লাস ফাইভে সে বৃত্তি পেয়েছে , তার উপরে আমার অগাধ আস্থা এবং সে আমার ছাত্র । আমি তাকে ক্লাস সেভেনে ভর্তি করাব । বছর শেষে পরিক্ষা পরিক্ষা না নিয়েই এইটে , একইভাবে ক্লাস নাইন , এসএসসি , এইচএসসি । আমার আস্থা আছে । সে আমার ছাত্র । মেধাবীরাই এ প্লাস কিংবা গোল্ডেন এ প্লাস পায় । তার মানে এই না যে সব এ প্লাস কিংবা গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া স্টুডেন্টই মেধাবী । এ প্লাস না পাওয়াও অনেক মেধাবী আছে , যারা শুধু রেজাল্ট এর ভিত্তিতে না বরঞ্চ মেধার ভিত্তিতেই ভার্সিটিতে পড়ার যোগ্যতা রাখে । এটা মাননীয় মন্ত্রীর জানা রাখা উচিৎ ।

একজন শিক্ষার্থী এইচএসসি পর্যন্ত এই দীর্ঘ ১২ বছরে যা শিখে ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষার আগের তিন মাসেই তার থেকে অনেক অনেক বেশি কিছু শিখে । স্কুল কলেজের লেখা পড়ার বাইরে যে জ্ঞানের আরও জগত আছে , জানার আরও যে অনেক কিছু আছে সেটা সে তখনই বুঝতে পারে । এইচএসসি র আগ পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থী ভালো করে জানে না তার মাতৃভূমি বাংলাদেশ সম্পর্কে , বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে জানে না পৃথিবী সম্পর্কে । কিন্তু ভার্সিটির পরিক্ষাগুলতে অংশগ্রহণ করতে হলে পৃথিবী জুড়ে জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় , অলিতে গলিতে তাকে ঘুরে আসতে হয় । জানতে হয় পৃথিবীর আপাদমস্তক । চুলচেরা বিশ্লেষণ । তাইলে খারাপ কিসে ? প্লাস , গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া একজন শিক্ষার্থী এইচএসসি পর্যন্ত বাংলার কি শিখে । না জানে ভালো বাংলা ব্যাকারন না জানে বাংলা সাহিত্তের ইতিহাস । কি লাভ সেই এ প্লাস পেয়ে ? ওই সব এ প্লাস ভার্সিটির ভর্তি পরিক্ষায় মুড়ির ঠোংগায় পরিণত হয় । ইংরেজি এবং সাধারণ জ্ঞানের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য । বর্তমানে ভর্তির যে প্রক্রিয়া চালু আছে তাকে আরও যুগোপযোগী করা যেতে পারে । তাই বলে ভর্তি পরীক্ষা অযৌক্তিক হতে পারে না কখনই ।

ফলাফলের ভিত্তিতে যখন ভার্সিটিতে ভর্তি করা হবে তখন তা ভর্তি বাণিজ্যে পরিণত হবে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই বলি । প্রতি বছর প্রায় পাঁচ হাজারের মত শিক্ষার্থীরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় । অথচ প্রতি বছর এ প্লাসের সংখ্যা চল্লিশ পঞ্চাশ হাজারের মত । এদের মধ্যে যদি পচিশ হাজার স্টুডেন্ট এর ইচ্ছে থাকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার , তাহলে মন্ত্রি মহাশয় কিসের ভিত্তিতে ওদের ভর্তি করাবেন ? টাকার মোটা অংকে না নিজেদের দলের নেতাদের টেলিফোন কলে আমি সেটা জানি না । এমনিতেই সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের উৎপাতে ভার্সিটি উত্যক্ত হয় সব সরকারের আমলেই । তারপরে এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে পড়ালেখার আর কোন পরিবেশই অবশিষ্ট থাকবে না ভার্সিটিগুলোতে

ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষার যে পক্রিয়া চালু আছে তা ধ্বংস করে ভার্সিটিগুলোকে ভর্তি বাণিজ্য কেন্দ্র আর নিজেদের ছাত্র সংগঠনের কারখানা বানানোর যে হাস্যকর কালচার চালু করার যে মত তিনি প্রকাশ করেছেন তা ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলতে হবে ।

আহমদ আল হুসাইন , শিক্ষার্থী
তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।  মোবাইল ০১৭১৪৭৯৬৬৬৯
ই মেইল  a_hmed_du@yahoo.com

মন্তব্যসমূহ